Thursday, February 17, 2011

খেলতে খেলতে লেখাপড়া

নাঈমুর রহমান, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, আল শাহরিয়ার, শাহাদাত হোসেন।
নামগুলো চেনা চেনা লাগছে কি? কেন লেখার শুরুতেই এই নামগুলো এল—এই প্রশ্ন করলে যে কেউ বলবেন, আরে! এরা তো আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের অতীত ও বর্তমান খেলোয়াড়!
উত্তর ১০০ ভাগ ঠিক। কিন্তু শুধু এ কারণেই এদের নাম এখানে উঠে আসেনি। আসলে এদের সবাই বের হয়েছেন বিকেএসপি থেকে। একইভাবে আমরা হকির মামুন-উর-রশীদ, জিমি, তুহিন, প্রিন্সের নাম বলতে পারি। পারি ফুটবলের হাসান আল মামুন, জাহিদ হোসেন এমিলি, মাসুদ রানার নাম। আর শুটিংয়ে সাফ ও কমনওয়েলথে সোনাজয়ী আসিফ হোসেন আর সাফের সোনাজয়ী শারমীনের নামও একই কারণে উচ্চারিত হবে। বাদ থাকবে না সাঁতারের কারার মিজানের নামও। তাহলে? তাহলে এই যে লেখাটি তৈরি হচ্ছে, তা বিকেএসপি নামে খেলোয়াড় তৈরির কারখানার গল্প বলার জন্যই তৈরি হচ্ছে, এ কথা বুঝতে হবে। চলুন ঘুরে আসি সেখান থেকে। ঘড়ির কাঁটাটা সবে ভোর ছয়টার ঘর ছুঁয়েছে। কাঁটাটা ছয়-এর ঘর ছোঁয়ামাত্রই সুমধুর সুরে বাঁচতে থাকে কলবেল। কিন্তু তা বিরক্তি ধরায় না ঘুমিয়ে থাকা শারমিন আক্তার, আযরা রেহানা, সালমান সাদিক, আশিক মাহমুদদের মনে। কারণ গভীর ঘুমের মধ্যেও এই কলবেলের প্রতীক্ষায় থাকে ওরা। কখন হবে ভোর আর কখনোই বা প্র্যাকটিস ড্রেস পরে হাতে তীর-ধনুক, বাস্কেটবল, হকিস্টিক, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল প্রভৃতি খেলার সরঞ্জাম নিয়ে দৌড়ে যাবে মাঠ, পুল, বক্সিং রেঞ্জ নয় তো বা সিনথেটিক ট্র্যাকে। সাদা, লাল, সবুজ, ছাইসহ আরও বর্ণিল রঙের প্র্যাকটিসের পোশাক পরে মুখরিত করে রাখবে বিকেএসপির প্রাঙ্গণ। এভাবেই ওদের কলকাকলীতে জেগে ওঠে বিকেএসপির প্রতিটি সকাল। আর এভাবেই খেলতে খেলতে পড়াশোনা চলে বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকেএসপিতে। সাধারণত যাদের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ ও খেলাধুলায় নিজের ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী, তাদের জন্য বিকেএসপি আদর্শ স্থান।
ঢাকা থেকে নন্দন পার্ক যাওয়ার রাস্তায় সাভারের জিরানীতে ১৫০ একর জমির ওপর সবুজ ছায়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)। ১৯৮৬ সাল থেকে নিয়মিত খেলাধুলার ওপর প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার ব্যবস্থা চালু করা হয় এখানে। বর্তমানে ৩৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ৩২ জন কোচের তত্ত্বাবধানে ৪৭৬ জন ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর থাকার জন্য রয়েছে আবাসিক ব্যবস্থা। ক্যাম্পাসের ভেতরেই রয়েছে ছেলে ও মেয়েদের জন্য দুটি আলাদা হোস্টেল। হাউসসুপারেরা শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করেন। সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে নয়টা ও বিকেল তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত দুটি সেশনে চলে খেলাধুলার প্রশিক্ষণ। তাই বলে ভাববেন না যে এখানে শুধু সারা দিন খেলাধুলা চলে। সকাল সাড়ে নয়টা থেকে দেড়টা এবং সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত একাডেমিক ভবনগুলোয় চলে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া। বিকেএসপির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ শওকত হোসেন জানান, বিকেএসপিতে মূলত খেলাধুলাকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই এখানকার শিক্ষার্থীরা। এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফলের পাশাপাশি ডিগ্রি (পাস কোর্স) ২০০৯-এ বাংলাদেশে প্রথম হয় এখানকার ছাত্রছাত্রীরা। এ ছাড়া খেলাধুলা যে পড়ালেখার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, তারই উদাহরণ হলো এখানকার ছাত্র জাতীয় দলের ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম। গত বছর এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ফাইভ পায় সে। শুধু পড়ালেখা আর খেলাধুলায় নয়, বিকেএসপিতে চলে নাচ, গান, আবৃত্তি, বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক সহশিক্ষা কার্যক্রম।
ঘুরে দেখা যাক পুরো বিকেএসপি
বাস থেকে নেমে বিকেএসপির প্রধান ফটকের দিকে যেতেই বিভিন্ন খেলাধুলার মুরাল স্বাগত জানাবে আপনাকে। মূল ফটক পার হতেই ভেতরে রয়েছে প্রধান কার্যালয়, ক্রিকেট মাঠ, সুইমিংপুল, জিমনেশিয়াম, সিনথেটিক ট্র্যাক, শুটিং কমপ্লেক্স, কলেজ ভবন, স্কুল ভবন, ছাত্র হোস্টেল, ট্রেনিং হোস্টেল, গেস্ট হোস্টেল, বক্সিং রেঞ্জ, হকির মাঠ, আর্চারির মাঠ, টেনিস কমপ্লেক্স, বাস্কেটবল গ্রাউন্ড। প্রতিটি স্থাপনাই সাজানো হয়েছে ছবির মতো করে। শুধু বাইরে নয়, স্কুল-কলেজের কক্ষগুলোও পরিপাটিভাবে সাজানো। আবাসিক হোস্টেল বলতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোট্ট একটি কক্ষ। এই কক্ষে নোংরা পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকছে সাত আটজন মানুষ; কিন্তু বিকেএসপির হোস্টেলের কক্ষগুলো সেই চিরাচরিত চেহারাই পাল্টে দিয়েছে। কেমন লাগে হোস্টেল জীবন? আয়েশা সিদ্দিকা, সোহেলা আক্তার, রাকিবুজ্জামান, রামকৃষ্ণ আচার্য্য, জুহি চাকমার কথায় বোঝা যায়, অনেক আনন্দেই তারা দিন কাটায় এখানে। তারা জানায়, রাত ১০টার পর যখন হাউসগুলোর সব বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়, তখনই শুরু হয় তাদের আসল মজা। অন্ধকারে ঘরের ভেতর লুকোচুরি, কানামাছি খেলে ওরা। কম্বল সিটিং বিকেএসপির তালিকাভুক্ত খেলা না হলেও (হোস্টেলে) হাউসগুলোর ভেতর জনপ্রিয় খেলা। কম্বল সিটিং? সেটা আবার কী ধরনের খেলা—জিজ্ঞেস করলে আয়েশা সিদ্দিকা জানায়, কম্বলের ভেতর একজনকে ঢুকিয়ে বাকিরা তার ওপর মজা করে কিল, ঘুষি দেয় এবং তাকে কোনোভাবেই বের হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় না। জিজ্ঞেস করি, এতে করে যাকে ঢোকানো হয় কম্বলের নিচে, সে রেগে যায় না? এটা তো একটা খেলা। রাগ করবে কেন? —জানায় আয়েশা। ওদের হাউসগুলোয় খাওয়ার মেন্যু খুবই ভালো। কখনো তা বাড়ির রান্না করা খাবারকেও হার মানায়। কী কী থাকে মেন্যুতে, জিজ্ঞেস করলে আশিক মাহমুদ জানায় (সবার পক্ষ থেকে), সকালে থাকে ডিম, স্যুপ, রুটি বা পরোটা, সবজি, ফল, জুস; দুপুরে ভাত, মাছ, মাংস, ডাল, সবজি ভর্তা ও সন্ধ্যায় ভাত, মাছ বা মাংসের তরকারি, ডাল, সবজি এবং রাত নয়টায় মিল্ক ব্রেকে দুধ/হরলিকস/কফি, কেক/বিস্কুট, চিপস, ফল। প্রতিবারই ডাইনিংয়ে বুফে সার্ভিসে খাবার পরিবেশন করা হয়। জানায় আশিক। হাউসে গল্প করতে করতেই বিকেলে প্রশিক্ষণের সময় হয়ে যায়। ওদের সঙ্গে যাই। আর্চারি, অ্যাথলেটিকস, বক্সিং, ক্রিকেট, জিমন্যাস্টিক, জুডো, শুটিং, সুইমিং, বাক্সেটবল, ফুটবল, হকি, টেনিস বিকেএসপিতে এই তালিকাভুক্ত ১২টি খেলার সব কয়টিতে ছেলেদের অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকলেও শেষের চারটিতে মেয়েদের অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্র্যাকটিস সেশনে চলে নিবিড় অনুশীলন। সেখানেই ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রিকেটার সুপ্তা রহমানের কাছে জানতে চাই, এত খেলা থাকতে ক্রিকেটকে বেছে নেওয়া কেন। সুপ্তা জানায়, সে এক দিন সেরা মহিলা অলরাউন্ডার (ক্রিকেটার) হয়ে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নাম তুলে ধরতে চায়। সব প্র্যাকটিস ইভেন্ট ঘুরে আর্চারি মাঠে আসি। সারিবদ্ধভাবে তীরধনুক হাতে ছেলেরা দাঁড়িয়ে যখন নির্দিষ্ট বোর্ডে লক্ষ্যভেদ করে, তখন মনে পড়ে মহাভারতের স্বয়ংবর সভার কথা। প্রতিটি খেলায় ছেলেমেয়েদের একসঙ্গেই চলে প্র্যাকটিস সেশন। এত নিয়মের বেড়াজাল, নিশ্চয়ই বাড়ির কথা মনে পড়ে সবার? হকির কোচ এক সময় এখানকার ছাত্র তবির-ই-নূর জানান, এত নিয়মের মধ্যেও এখানে সহপাঠীদের মধ্যে গড়ে ওঠে হূদ্যতা। আর খেলার প্রতি যাদের রয়েছে অদম্য টান, তারাই কেবল পড়তে আসে বিকেএসপিতে। এ কারণে বিকেএসপির সঙ্গে গড়ে ওঠে তাদের আত্মার বন্ধন। সেই বন্ধন ছিন্ন করা খুবই কঠিন। কারণ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়ালেখা করেও বিকেএসপির মায়া ছাড়তে না পেরে আবার এখানেই ফিরে এসেছি কোচ হয়ে। শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন দেখে এক দিন বিকেএসপির গর্বিত সন্তান হয়ে দেশের নাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যাবে। তাই ওরা ঘুমের মধ্যেও সজাগ রাখে ওদের শ্রবণশক্তি, কখন বাজবে সেই প্রতীক্ষিত কলবেলটা। সেই ধ্বনি শুনেই ওরা দৌড়ে যাবে প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডে, কঠোর অনুশীলনে।
জেনে নেওয়া যাক বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার নিয়ম
বিকেএসপির মূল উদ্দেশ্য হলো বয়সভিত্তিক ক্রীড়া মেধাসম্পন্ন খেলোয়াড়দের দীর্ঘমেয়াদি বিজ্ঞানভিত্তিক ক্রীড়া প্রশিক্ষণসহ সাধারণ শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষিত খেলোয়াড় তৈরি করা। সাধারণত যারা এখানে ভর্তি হতে চায়, তাদের খেলাধুলায় প্রতিভাবান, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা এবং বয়সভিত্তিক শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। ফেব্রুয়ারি মাসে পত্রিকায় দেওয়া বিজ্ঞাপন অনুযায়ী জীবনবৃত্তান্ত, বর্তমান ঠিকানা ও চার কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবিসহ লিখিত আবেদন বিকেএসপির মহাপরিচালকের বরাবর পাঠাতে হবে। এরপর বিকেএসপির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নির্দিষ্ট দিনে প্রশিক্ষণার্থীদের চূড়ান্ত ভর্তির জন্য বাছাই করা হবে। মহাপরিচালকের কাছে যাদের আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে, তাদের সঙ্গে বিকেএসপির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হবে। ১০ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের বিকেএসপিতে ভর্তি করা হয়। পড়ালেখার সম্পূর্ণ ব্যয় নির্ভর করে অভিভাবকের আয়ের ওপর।

No comments:

Post a Comment