যে জিনিসটাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই সে জিনিসটাই আমার সাথে সবসময় হয়। এবারও হয়েছে। এস এস সি পরীক্ষাটা এমন হয়েছে পাশ করব না ফেল করব ঠিক বুঝতে পারছি না। পদার্থ বিজ্ঞান পরীক্ষাটাই যত ঝামেলার মূল। পরীক্ষাটা আরেকটু ভাল হতে পারতো না। অথবা আরেকটু খারাপ হলেই বা ক্ষতি কি ছিল। না হয় পরের বার আবার পরীক্ষা দেয়ার জন্য এখন থেকেই পড়াশোনা শুরু করে দিতে পারতাম। তা না আমাকে একটা দু’টানার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এর জন্য এখন কোন কাজে মন বসাতে পারছি না। শান্তিতে একটু ঘুমাতেও পারছি না। মাথার মধ্যে সারাক্ষণ সেটা ঘুর ঘুর করে। পাশ করবো না ফেল করবো ফেল করবো না পাশ করবো।
এলাকার এক বড় ভাই বললেন খানিকটা দূরে নাকি পাগলা মামা নামে একজন লোক থাকেন। তিনি নাকি মানুষের ভবিষ্যত বলে দিতে পারেন। তাঁর কাছে গেলে আমার এস এস সি পরীক্ষার ফলাফল জেনে নিতে পারব। কথাটা এই প্রথম শুনলাম। তাই ভাবলাম পাগলা মামার কাছে যাওয়ার আগে তাঁর সম্পর্কে একটু খোঁজ খবর নেয়া দরকার। পরিচিত আরেক বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম পাগলা মামার কথা। তিনিও বললেন ঘটনা সত্যি। কারণ তিনি ও তার এক বন্ধু নাকি এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়ে পাগলা মামার কাছে গিয়েছিলেন ফলাফল জানার জন্য। পাগলা মামা তাঁকে বললেন তুমি ২য় বিভাগে পাশ করবে আর তাঁর বন্ধুকে বললেন তুমি ফেল করবে। পরে যখন ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে তখন দেখা গেছে ঠিকই তিনি ২য় বিভাগে পাশ করেছেন এবং তার বন্ধু ফেল করেছে।
ভাবলাম আমারও যাওয়া দরকার। কিন্তু একা একা যেতে সাহস পাচ্ছি না। তাই অনেক কষ্টে আমার মত আরেক জনকে খুঁজে বের করেছি। তার নাম জুবায়ের। 
তারপর একদিন সকালে আমি আর জুবায়ের সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পাগলা মামার খোঁজে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে পাগলা মামার বাড়িতে পৌঁছলাম। কিন্তু হায়! পাগলা মামার বাড়িতে এত ভীড় কেন! উঠানের মধ্যে সবাই বৃত্তের মত গোল হয়ে বসে আছে এবং তার ভেতর একটি লোক লাঠি হাতে নিয়ে হাঁটা হাঁটি করছে। আমাদের সাইকেলটি একটু আড়ালে রেখে ভীড় টেলে একটু সামনে এসে উঁকি দিতেই সেই লোকটি বলল আসেন আসেন বলেই আমাদেরকে হাত ধরে টেনে সবার সামনে নিয়ে গেলেন এবং বললেন আপনারা পরীক্ষার ফলাফল জানতে এসেছেন, তাই না? কিন্তু আপনাদেরকে তো আজকে সিরিয়াল দিতে পারব না। আপনাদেরকে আগামীকাল আসতে হবে। তখন বুঝতে পারলাম তিনিই পাগলা মামা। তারপর আমি আর জুবায়ের সাইকেল নিয়ে চলে আসলাম।
পরদিন সকালে আবার গেলাম। কিন্তু একি! আজ যে আরও ভীড়। মনে হয় না বিকেলের আগে সিরিয়াল পাব। সারাদিন বসে থাকার পর বিকেল তিনটার দিকে আমাদেরকে ডাকল। জুবায়ের এর দিকে আঙ্গুল তুলে পাগলা মামা বলল, ‘তুমি পরীক্ষায় নকল করেছ।’ জুবায়ের মাথা নিচু করে বলল, ‘জ্বি।’ তখন উঠানে বসা সবাই হাসি শুরু করল। তারপর পাগলা মামা বলল তোমরা দুইজনই পাশ করবা। জুবায়েরকে বলল সে দ্বিতীয় বিভাগে আর আমি তৃতীয় বিভাগে। তারপর দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আমি আর জুবায়ের পাগলা মামার বাসা থেকে চলে আসলাম।
আমার দু’টানা সমস্যাটা আরও বেড়েছে। এখন সেটি হল তিন-টানা। আমার একটি পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। সেটিতে ফেল করলেও মোট b¤^i প্রথম বিভাগেরই থাকবে। কিন্তু আমি কীভাবে তৃতীয় বিভাগ পাবো সেটা কোন ভাবেই আমার মাথায় ঢুকছে না। আবার পাগলা মামার কথাটাকে উড়িয়ে দিতেও পারছি না। 
অবশেষে সেই বহু প্রত্যাশিত দিন আসল। আজ এস এস সি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবে। জোবায়ের আর আমি আগে থেকেই প্লেন করেছি। বাসা থেকে টাকা পয়সা নিয়ে বের হবো। যদি আমাদের ফলাফল খারাপ হয় তাহলে রেলস্টেশনে গিয়ে যে ট্রেন পাই সেই ট্রেনে চড়ে কোথাও চলে যাব। দুই চার দিন পর টাকা পয়সা শেষ হলে তারপর বাসায় ফিরব। যেই ভাবা সেই কাজ। আমরা বিকালে স্কুলে গেলাম ফলাফল জানার জন্য। প্রধান শিক্ষক সবাইকে ডাকলেন। এক এক করে সবার ফলাফল বলতে লাগলেন। আমি এবং জুবায়ের দুই জনই পাশ। জুবায়ের দ্বিতীয় বিভাগ পেলেও আমি প্রথম বিভাগ। তখন বুঝতে পারলাম পাগলা মামার কথা সব সময় ঠিক হয় না।
পরদিন শুনলাম আমাদের সহপাঠী আশীষ নাকি ফেল করেছে এবং ওকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুনে আমি আর জুবায়ের একজন অন্য জনের দিকে তাকাই আর হাসি। এটা তো আমার আর জুবায়ের এর গোপন পরিকল্পনা। এটা আশীষ জানল কীভাবে?
একদিন-দুইদিন, এক সপ্তাহ-দুই সপ্তাহ এভাবে আজ প্রায় দশ বছর হয়ে গেল। আশীষ আর ফিরে এলো না। আশীষের কথা চিন্তা করতে করতে ওর মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে কিছু দিন আগে মারা গেছে। এখন ওর বাবার অবস্থাও বেশি ভাল নয়। জানি না আশীষ বেঁচে আছে কি-না। তারপরও বলছি, আশীষ তুমি যেখানেই থাকো বাসায় ফিরে এসো। তোমাকে এখনো তোমার আব্বু, ভাই, বোনসহ আমরা অনেক মিস করি।   -মো. আমিনুর রহমান